জানি না আমার আশঙ্কাটা ভুল কিনা। বিষয়টি আমার চোখে খুবই উদ্বেগজনক এবং অস্বস্তিকর
ঠেকেছে।
২০ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতায় ছিলাম। কলকাতায় পৌঁছেই
ছুটে গেলাম ২৮ তারিখ নন্দনে অর্থাৎ বাংলা আকাদেমি প্রাঙ্গণে। তখন মাত্র বিকেল হয়েছে।
লোকে লোকারণ্য প্রাঙ্গণ। আকাদেমি প্রতিষ্ঠিত শিশু-কিশোর আকাদেমির দুতলায় চলে গেলাম।
সেখানে আমার প্রতীক্ষায় ছিলেন শ্রদ্ধেয় শ্যামলদা অর্থাৎ কবি ও শিশুসাহিত্যিক শ্যামলকান্তি
দাশ। আমাকে দেখে হৈ হৈ রৈ রৈ করে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। এই নিয়ে তাঁর
সঙ্গে আমার একাধিক বার সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রথম সাক্ষাৎ ছিল ২০০৫ সালে। এবারও পেয়ে আনন্দে
উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, সেখানে ছিলেন অন্যান্য কবি ও লেখকরা পরিচয় করিয়ে দিলেন যেমন--শঙ্কর
চক্রবর্তী, অপূর্ব দত্ত, দেবাশীষ বসু, অর্নিবাণ ঘোষ, বেলা দাস প্রমুখের সঙ্গে। বেলা
দাস তার সম্পাদিত বেশ বড় একটি সাহিত্য সংকলন 'ভালোবাসার অমল দিগন্ত' আমাকে উপহার দিলেন।
শ্যামলদা এখন শিশু-কিশোর আকাদেমির মাসিক সাহিত্য কাগজ 'সবুজ সাথী'র অন্যতম সহযোগী সম্পাদক।
তাছাড়া বহুল প্রচারিত কবিতার মাসিক সাময়িকী 'কবিসম্মেলন' এর সম্পাদক হিসেবে তো আছেনই।
যাহোক, কিছুণ আড্ডা মেরে নিচে নামলাম সকলে। তখনই দেখলাম চত্বরে
সাজানো মঞ্চে চলছে 'কথাসাহিত্য উৎসব ২০১১' শীর্ষক একটি চমৎকার অনুষ্ঠান। পাঁচদিনব্যাপী
অনুষ্ঠানটি এবার নিয়ে ১১তম। আয়োজক পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। কিন্তু একি হালহকিকত অনুষ্ঠনটির!
বিস্মিত হয়ে চারদিকে তাকালাম। প্রচুর লোকজন এখানে সেখানে জটলা বেঁধে কথা বলছে, চা-কফি
পান করছে, হাসি-ঠাট্টায় মশগুল সবাই কিন্তু অনুষ্ঠানটির দিকে কেউই ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত
করছে না! অবিশ্বাস্য মনে হল আমার কাছে কারণ বাঘা বাঘা কবি ও কথাসাহিত্যিকরা এখানে উপস্থিত
রয়েছেন। অথচ জনা কয়েক দর্শক মাত্র চেয়ারগুলোতে বসে আছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অনুষ্ঠানটি কাউকেই
যেন আকর্ষণ করছে না। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!
আমি বিষয়টি শ্যামলদাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি হাসলেন। তারপর কয়েক
মিনিট বসে আমাকে নিয়ে আকাদেমির প্রশাসসিক ভবনে গেলেন। প্রশাসন কর্মকর্তা উৎপল ঝা আমাকে
সাদর আমন্ত্রণ জানালেন, এর আগে ২০০৫ সালে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। চিনতে পারলেন। দেখলাম
তাকে ঘিরে আরও চার-পাঁচজন মানুষ অপরিচিত, শ্যামলদা এক এক করে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রায়
ঘন্টা খানেক আড্ডা চলল বিভিন্ন বিষয়ে, চা পান করা হল। জাপানের ভূমিকম্প ও ৎসুনামি নিয়েও
আলাপ হল। অনেকেই জানতে চাইলেন আমার কাছে প্রকৃত ঘটনা। আমি যতখানি পারি বললাম। শ্যামলদা
বললেন, প্রবীর নতুন সংখ্যা কবিসম্মেলনে কবির দৃষ্টিতে এবারের ভয়াবহ ভূমিকম্প নিয়ে একটি
লেখা লিখেছে। পড়লে অনেক কিছু জানা যাবে।
আড্ডা শেষে সকলকে বিদায় দিয়ে আমি চলে এলাম। সঙ্গে নিয়ে নিলাম
কথাসাহিত্য উৎসবের ক্ষুদ্র একটি নির্দেশিকা। বাইরে এসে দেখি অনুষ্ঠানটি তখনো চলছে কিন্তু
বক্তাদের বক্তব্য শোনার মতো শ্রোতা নেই। ভাবতেই পারলাম না! আমাকে যেতে হবে বহু দূরে
বারাসাতে তাই বাধ্য হয়ে বাস ধরতে ছুটলাম। মনে মনে একটা সূচালো অস্বস্তি থেমে থেমে আমার
মনোজমিনে ছিদ্র খুঁড়তে লাগল: এত বড় একটি আয়োজন অথচ কোনো উচ্ছ্বাস, আনন্দ এমনকি কৌতূহল
পর্যন্ত বাঙালিদের নেই কথাসাহিত্য সম্পর্কে! এটা কী হতে পারে! কথাসাহিত্য কী তবে অপাঙতেয়
হয়ে উঠছে!
ডেরায় ফিরে নির্দেশিকা খুলে দেখি আয়োজনটা অপরিসীম গুরুত্ববহ।
এটা ঢাকায় করা অতটা সম্ভব নয় বলেই ধারণা করি। ওপারে হয়েছে কিন্তু সাড়া পড়েনি বললেই
চলে। যে ক'দিন কলকাতায় ছিলাম একটি খবরের কাগজেও কোনো সংবাদ দেখলাম না এটাও আশ্চর্য
বৈকি! অথচ পরিকল্পনাটা কী বিশাল: ২৫ তারিখ উদ্বোধন করলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। সম্মানীয়
অতিথি ছিলেন ধ্রুবজ্যোতি বোরা ও বাণী বসু। সভাপতিত্ব করেন আকাদেমির সভাপতি কবি নীরেন্দ্রনাথ
চক্রবর্তী। সংবর্ধনাজ্ঞাপন করেন অর্নব সেন, অশোকরঞ্জন সেনগুপ্ত। পুরস্কার পেলেন এবার
দুজন যথাক্রমে তন্বী হালদার, সুতপা রায়চৌধুরী স্মারক পুরস্কার এবং সমীরকুমার গুপ্ত,
সুপ্রভা মজুমদার স্মারক পুরস্কার। যে দুজনের নামে পুরস্কার প্রদান করা হল এটাও অনুরকণীয়
কেননা যারা হারিয়ে গেছেন তাদেরকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। সুতপা রায়চৌধুরী অভিনয়,
শিক্ষা ও সাহিত্যপ্রীতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। সুপ্রভা মজুমদার ওড়িশার
ভুবনেশ্বরের মন্দিসমূহের স্থাপত্যশৈলী নিয়ে কাজ করেছেন। ইতিহাস, সাহিত্য, সঙ্গীত ও
খেলাধুলায়ও বিশেষ কর্মযজ্ঞের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। প্রাপক তন্বী হালদার একজন প্রতিষ্ঠিত
গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তার 'জলাভূমি' একটি বিখ্যাত উপন্যাস। সমীরকুমার গুপ্ত ব্যক্তিজীবনে
একজন শৈল্যচিকিৎসক হলেও সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা তার ধ্যানজ্ঞান। 'মিলেমিশে' নামক সাহিত্য
পত্রিকার সম্পাদক সমীরবাবুর 'এক আকাশের এপার ওপার' একটি অসামান্য গ্রন্থ।
উদ্বোধনের দিনেই অবমুক্ত করা হল কথাসাহিত্য বিষয়ক প্রদর্শনী।
এই প্রদর্শনীতে এমন কিছু গল্পকারকে তুলে আনা হয়েছে যারা জনপ্রিয়তার স্রোতে উঠে আসতে
না পেরে হারিয়ে গেছেন। পরিকল্পনা ও বিন্যাসে ছিলেন অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী। তারপর
ছিল আলোচনা: শতবর্ষে বিমল মিত্র, আলোচক শুভেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোচনা ছিল নিজেদের
লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করেছেন ধ্রুবজ্যোতি বোরা, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামকুমার মুখোপাধ্যায়,
আবুল বাশার, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়। সঞ্চালক ছিলেন সুসাহিত্যিক বাণী বসু।
এরপর আকাদেমি সভাঘর এবং জীবনান্দ সভাঘরে ছিল গল্পপাঠ অংশগ্রহণকারী
নবীনপ্রবীণ মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন। এদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নাম নজরুল ইসলাম, কণা বসুমিশ্র,
তিলোত্তমা মজুমদার, সুনীল জানা, বীরেশ্বর মুখোপাধ্যায়, তন্বী হালদার প্রমুখ। সঞ্চালক
ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত এবং ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়। কেমন দর্শক-শ্রোতা হয়েছেন জানি না।
২৬ তারিখ বিমল মিত্র মুক্তমঞ্চে ছিল একাধিক অনুষ্ঠান। পরিকল্পনায়
ছিল: গল্পপাঠ, ন'জন গল্পকারের নাম দেখা যাচ্ছে। এরপর আলোচনা: স্বদেশি আন্দোলনের ধারা
ও রবীন্দ্র কথাসাহিত্য আলোচক বারিদবরণ ঘোষ, শুভঙ্কর ঘোষ, শ্রাবণী পাল, উত্তম পুরকাইত।
সঞ্চালক সনৎকুমার চট্টোপাধ্যায়। আবার আলোচনা: এ সময়ের বাংলা কথাসাহিত্য: আলোচকের চোখে,
আলোচক পৃথ্বীশ সাহা, বরেন্দু মন্ডল, বিশ্বজিৎ পান্ডা, রাহুল দাশগুপ্ত। সঞ্চালক সুমিতা
চক্রবর্তী।
আকাদেমি সভাঘরে গল্পপাঠ, তেরো জনের নাম মুদ্রিত আছে। তারপর কথাসাহিত্য:
সম্পাদকদের ভাবনা। সম্পাদকদের নাম দেখা যাচ্ছে দেবব্রত চট্টোপাধ্যায় (পরিকথা), বাসব
দাশগুপ্ত (নীললোহিত), অলোক গোস্বামী (গল্পবিশ্ব), সুবল সামন্ত (এবং মুশায়েরা), প্রদীপ
ভট্টাচার্য (একালের রক্তকরবী), আশিস পান্ডে (বাংলার আভাষ)। সঞ্চালক অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়।
আবার গল্পপাঠ, বারো জনের নাম দেখা যাচ্ছে। সঞ্চালক রমানাথ রায়।
জীবনানন্দ সভাঘরে আলোচনা: আখ্যান সৃষ্টির নেপথ্যে, আলোচক অতীন্দ্রিয়
পাঠক, সোহারাব হোসেন, শাহযাদ ফিরদাউস, সুকান্তি দত্ত, অনিন্দিতা গোস্বামী। সঞ্চালক
দেবর্ষি সারোগী। গল্পপাঠ, তেরো গল্পকারের নাম দেখা যাচ্ছে। সঞ্চালক সুনীল দাস। আবার
গল্পপাঠ পনেরো জন। সঞ্চালক পীযূষ ভট্টাচার্য। দেখা হয়নি, জানি না কতজন এসেছেন বা অংশগ্রহণ
করেছেন।
২৭ তারিখ বিকেলে বিমল মিত্র মুক্তমঞ্চে কথাসাহিত্যিকের মুখোমুখি
অনুষ্ঠান। অতিথি দিবেন্দু পালিত, প্রশ্নকর্তা শচীন দাশ এবং অতিথি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ:
কিন্নর রায়। সঞ্চালক বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য। সন্ধে বেলা আলোচনা: পাঠকের চোখে এখনকার
কথাসাহিত্য, আলোচক সমীরকুমার গুপ্ত, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রসাদ রায়, তাপস
গঙ্গোপাধ্যায়। সঞ্চালক অরুণকুমার বসু। এরপর আবার আলোচনা: ফিরে দেখা গল্পকার। প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায়: সত্রাজিৎ গোস্বামী; প্রমথ চৌধুরী: সুরজিৎ দাশগুপ্ত; উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়:
সোনালি মুখোপাধ্যায় এবং গোকুল নাগ: সুমনা দাশশূর। সঞ্চালক উজ্জ্বলকুমার মজুমদার। একই
সময়ে আকাদেমি সভাঘরে গল্পপাঠ, আঠারো জনের নাম মুদ্রিত। সঞ্চালক অভিজিৎ সেন। এরপর আলোচনা:
ফিরে দেখা গল্পকার। মণীশ ঘটক: বিকাশকান্তি মিদ্যা, ননী ভৌমিক: বারিদবরণ চক্রবর্তী,
সুলেখা সান্যাল: মিহির সেনগুপ্ত এবং ছবি বসু: স্বপনকুমার মন্ডল। সঞ্চালক মানস মজুমদার।
আবার গল্পপাঠ, পাঠকারী পনেরো জন। জীবনানন্দ সভাঘরে গল্পপাঠ, সতেরো জন। সঞ্চালক আফসার
আমেদ। বিরতি দিয়ে আবার গল্পপাঠ, পনেরো জন। সঞ্চালক সুখেন্দু ভট্টাচার্য। বিরতি দিয়ে
পুনরায় গল্পপাঠ, গল্পকার তেরো জন। সঞ্চালক অমর মিত্র। প্রকৃতপক্ষে কতজন গল্পপাঠ করেছেন
আর শ্রোতা কতজন ছিলেন সন্দেহ থেকেই যায়।
২৮ তারিখ বিমলমিত্র মুক্তমঞ্চে বিকেলে আলোচনা: কথাসাহিত্য: পাঠক
সমাজ ও গ্রন্থাগার, আলোচক রামপ্রসাদ দত্ত, কবিতা মুখোপাধ্যায়, দেবেশকান্তি চত্রবর্তী,
তুষার পন্ডিত ও মধুসূদন চৌধুরী। সঞ্চালক উৎপল ঝা। সন্ধেবেলা আলোচনা: বিভিন্ন ভারতীয়
ভাষায় বাংলা উপন্যাস, আলোচক সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় (হিন্দি), বাসুদেব দাস (অসমিয়া), বিপ্লব
চক্রবর্তী (মারাঠি), জি. কুমারাপ্পা (কন্নড়) এবং মৃণালকান্তি দাস (ওড়িয়া)। সঞ্চালক
পল্লব সেনগুপ্ত। বিরতি দিয়ে আবার আলোচনা: দূরের জানালা: বিদেশি কথাসাহিত্য, আলোচক তরুণ
ঘটক (স্প্যানিস), চিন্ময় গুহ (ফরাসি), শুভময় মন্ডল (মধ্যপ্রাচ্য), নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
(ইংরেজি), শেখর বসু (ইংরেজি) এবং পার্থ রাহা (ইংরেজি)। সঞ্চালক এষা দে।
একই দিনে বিকেলে আকাদেমি সভাঘরে গল্পপাঠ, তেরোজন। সন্ধেবেলা
আলোচনা: রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে বিজ্ঞান চেতনা, আলোচক জগদিন্দ্র মন্ডল, দেবলীনা শেঠ,
সাধন চট্টোপাধ্যায়। সঞ্চালক শ্যামল চক্রবর্তী। বিরতি দিয়ে গল্পপাঠ, ষোল জন। সঞ্চালক
নলিনী বেরা। জীবনানন্দ সভাঘরে বিকেলে গল্পপাঠ, ন'জন। সঞ্চালক নলিকন্ঠ ঘোষাল। সন্ধেবেলা
গল্পপাঠ, দশজন। সঞ্চালক অরিন্দম বসু। বিরতি দিয়ে আবার গল্পপাঠ, চৌদ্দ জন। সঞ্চালক ভগীরথ
মিশ্র। এটাও আমার দেখা হয়নি। জানি না কি অবস্থা হয়েছিল।
শেষের দিন অর্থাৎ ২৯ তারিখ সকালে বেরিয়ে দক্ষিণ কলকাতার যাবদপুরের
দিকে অজনয়নগরে থাকেন ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক ও সমালোচক সুরজিৎ দাশগুপ্তর বাড়িতে গিয়েছিলাম।
সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাউসে। সেটা দেখে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় চলে গেলাম সল্টলেকে
অবস্থিত রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে। বড়ই নির্জন বিশাল কিন্তু দৃশ্যমান ভবনটিতে ২৯ তারিখ
ছিল কথাসাহিত্য উৎসবের শেষ দিন। শুরু হওয়ার কথা ছিল ছ'টায়। কিন্তু শুরু হল সাড়ে ছ'টায়।
কারণ লোকজন নেই! রথীমহারথীরা হাজির যেমন--কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সনৎকুমার চট্টোপাধ্যায়,
অধ্যাপক পবিত্র সরকার, সবিতেন্দ্রনাথ রায়, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। ভবনের প্রবেশদ্বারের
খোলা জায়গায় সকলে একদফা চা খেলেন। দর্শক-শ্রোতাদের জন্য প্রতীক্ষা। এত বড় একটি জাতীয়
অনুষ্ঠানে লোকজন না আসা আসলেই বিরাট খটকা আমার জন্য কারণ আমি প্রবাসী। বিদেশে থেকে
কলকাতার সাহিত্য বাসর জমজমাট হয় বলে বিশ্বাস করে থাকি। সবাইকে দেখলাম সাবলীল। অনুষ্ঠান
শুরু হল। সূচনা করলেন উৎপল ঝা। আজকের সমাপনী দিবসের আলোচনা: সাহিত্যের আড্ডা, অংশগ্রকারীদের
নাম দেখলাম নির্দেশিকায় নবনীতা দেব সেন, সবিতেন্দ্রনাথ রায়, অনুপ মতিলাল, স্বপ্নময়
চক্রবর্তী, হর্ষ দত্ত, চন্দন সেন, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। সঞ্চালক পবিত্র সরকার। মঞ্চে
অনুপস্থিত দেখলাম অনুপ মতিলাল আর পাক্ষিক 'দেশ' সম্পাদক হর্ষ দত্তকে। উৎপল ঝা সঞ্চালকের
হাতে মাইক ছেড়ে দিলেন। প্রথমে বললেন মিত্র এবং ঘোষ পাবলিশার্সের বহুকালদর্শী বয়োজ্যেষ্ঠ
শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব সবিতেন্দ্রনাথ রায় তথা সকলের প্রিয় ভানুদা। যাঁর লিখিত অসাধারণ
গ্রন্থ 'কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর' দুখন্ড পড়ে অসম্ভব আন্দোলিত হয়েছি। তিনি বইপাড়ায়
সাহিত্যের আড্ডা কেমন দু-তিনটি ঘটনা বললেন। যা আমরা প্রথম জানলাম। এরপর গল্পকার সুকান্ত
বললেন। ধরাবাহিকভাবে অন্যরাও। কিছু দেরি করে এসেছিলেন নবনীতা দেব সেন। এই প্রথম তাঁকে
প্রত্যক্ষ দেখার সৌভাগ্য হল। টোকিও থেকে মাঝে মাঝে তাঁকে মেইল করি, কদাচিৎ উত্তর মেলে
তাতেই আমি কৃতার্থ। তিনি তার বিদেশে অবস্থানকালীন স্মৃতিচারণ করলেন। তারপর পবিত্র সরকার
বললেন। তাঁদের কথা থেকে অনেক নতুন তথ্য জানার সৌভাগ্য হল আমার। ৫০০ আসনের মিলনায়তনে
আমরা সর্বসাকুল্যে ছিলাম ১৪ কি ১৫ জন! অন্ততপক্ষে আজকে প্রচুর কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক
এবং সাহিত্যপ্রিয় লোকজন আসবেন বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু দারুণ হতাশ হলাম।
দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চে এলেন আকদেমির সভাপতি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
এবং সচিব সনৎকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁরা সকলকে ধন্যবাদ দিলেন। এবং আগামী বছর আবার মিলিত
হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।
পরিশেষে ছিল জলযোগ। আমিও অংশগ্রহণ করলাম। কলকাতার সাহিত্যজগত
সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই কিন্তু প্রবলভাবে অনুভব করলাম কয়েকটি ভাগে বিভক্ত এখানকার
সাহিত্যজন। দলাদলিও কম নেই। এসবও সাধারণ সাহিত্যমোদী মানুষকে প্রভাবিত করে বলেই কি
দর্শক-শ্রোতারা কমে যাচ্ছেন নাকি আসলেই চিত্তাকর্ষক তথ্যপ্রযুক্তি সর্ব শ্রেণীর মানুষকে
সাহিত্য থেকে আলগা করে নিচ্ছে কে জানে! তবে এই বাতাসটা সংক্রামক এবং সাহিত্যের জন্য
আদৌ স্বস্তিকর নয় তাৎক্ষিণকভাবে এটাই মনে হল।
Editor : Probir Bikash
Sarker
Powerd by Manchitro Publishers, 2011 Copyright © All Rights Reserved.